প্রকাশিত: Sun, Apr 21, 2024 2:51 PM
আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 4:37 AM

এলিজি : শিবনারায়ণ দাশ

ইকবাল আনোয়ার : শিবুদা আমাদের পাড়ার মানুষ। দক্ষিণ বাঁগিচাগাও কুমিল্লা। আমাদের পাড়ার গৌরব। একটা গলিতে আমরা খেলতাম। স্কুলে পড়ি। জীবন আমার বন্ধু। সাত্তার বন্ধু। তারা ভালো ফুটবল খেলে। জীবন নাই এ ধরায়। সাত্তার আছে। জীবন বা সাত্তারের একজন একদলে থাকতো। আমরা জনা পাঁচ সাত। অন্যদলে। বলই পেতাম না। গোলের পর গোল খেতাম। শিবুদা দেখে হাসতেন। সবাই একত্রে একজনের সঙ্গে পারস না। গলিটা পাড় হলে দুই পাশে দুই পুকুর। মাঝখানে ঠাণ্ডা একটা বাড়ি। ছনের ঘর, মাটির মেঝে। চারদিকের গাছ গাছালির অন্ধকারে উঠানে রোদই পড়ে না। সেই নীচু চালের বাড়ির পশ্চিমের ঘরে শিবুদা থাকেন। লেবুর ঝোঁপ। সাদা ফুল। পুকুরের পাড়ের দিকে রোদ কিছুটা পরে। সেখানে নয়নতারা। শিবুদা প্রায়ই জেলে থাকেন। মাঝে মাঝে বাসায় আসেন। জেলে চর্টার করা হয়, হাই পাওয়ারের বাল্ব জ্বেলে। যতোবারই আসেন বাড়িতে, তার চশমার পাওয়ার বাড়ে। ছোট খাটো চিকন চাকন মানুষ। 

সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। চোখের কোঠরে প্রত্যয় জড়ানো আলো। আমি আশ্চর্য হই। তার মতো বিপ্লবী হতে মন চায়। এবার ক’দিন থাকবেন শিবুদা? সেটা সরকার জানেন। চল কেরাম খেলি।

পাড়ার বড় রাস্তার পাড়ে অলিমিয়া খলিফার দোকান। সেখানে সিঙ্গার মেশিন বসানো। অলিচাচা যতোটা না দরজি, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতিবিদ। সব খবর রাখেন। পাড়ার সব মুরব্বি সেখানে এক ব্যান্ডের রেডিওতে খবর শোনেন। তারপর চলে আড্ডা। আমরা যারা ছোট তারাও সামনে ল্যাম্প পোষ্টের নীচে জমা হই। দোকানের সামনে সমান জায়গায় ক্যারামের বোর্ড বাসানো। দোকান থেকে বরিক কেনা হয়। খেলা শুরু হয়। কাঠের গুটি। শিবুদার কাছে স্ট্রাইকার গেলে সেটা আর ফিরে আসে না। একটার সঙ্গে আরেকটা ঘষে উদ্ধার করে, বিপক্ষের গুটি বেকায়দায় ফেলে চমৎকার শিল্পীত খেলা খেলে চলেন তিনি। আমি সেই খেলা শিখে সিলেটে গিয়ে মাৎ করি। শিবুদার এ গুণটার কথা উল্লেখ করতে হলো, অনেকে বোধহয় জানেন না। তিনি জেলা পর্যায়ে সেরা ছিলেন। আমরা বলি, শিবুদা, জীবন বা সাত্তার কি দোষ করলো, আপনিওতো স্ট্রাইকার পেলে আর ছাড়েন না।

শিবুদার ঘরখানা ছোট। সেখানে কেবল বই আর নানা রকম কলম, তুলি, রং। তিনি সে সময় তিনি সবচেয়ে ভালো চিকা মারতেন। রেড অক্সাইডের সঙ্গে গাম গুলে এক মোক্ষম রং তৈরি হতো, যা ছিলো অক্ষয়। আমি তার থেকে তালিম নিয়ে মেডিকেলের প্রাঙ্গণ শুধু নয়, সারা সিলেট শহর রাঙিয়ে ফেলি সঙ্গে মঞ্জুর রশিদ চৌধুরী। তার কাছ থেকে শিখি, কী করে ম্যাগাজিন তৈরি করতে হয়। তার সম্পদিত একটা ম্যাগাজিন ছিলো নামÑ অশ্রু হলো বারুদ। কী অপূর্ব নাম। কালো কাগজে সাদা অক্ষর। একপাতা অংকন। তার আল্পনা, তার বিন্যাসশৈলী, তার সজ্জায় মনোরম হয়ে প্রকাশিত হয় চমকের পর চমক। প্রচ্ছদসহ সবকিছুতে নতুনত্ব। 

তিনি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন বই। কী করে জার অত্যাচার করছেন, তার ওপর ভিত্তি করে একটা ভাষ্কর্যের বই। সম্ভবত বইটা এখনো আছে। সেই বইয়ের ভাষ্কর্য চরিত্রগুলো যেন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, তাদের চোখে কষ্টের বয়ান, তাদের শীর্ণ মাংশপেশী যেন বিপ্লবের অক্ষরে অক্ষরে স্বাক্ষরিত। ছাব্বিশে মার্চ মধ্যরাতে পাক হানাদার তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে যায়, আর তাঁকে পাওয়া যায়নি। পুত্রের সংগ্রামী জীবনের কাফফরা এভাবে তাকে, পুরো পরিবারকে দিতে হয়। আগে ভাগে জেনেই শিবুদা পলাতক হন। সিগনেচার কলমগুলো আমাকে দিয়ে যান। 

তার ছোট ভাই শ্যামল আমার বন্ধু। তারও ছোট কমল এখন আমেরিকায়। আমি আমেরিকা গেলে কমল এসে দেখা করে। বড় আনন্দ পাই। আর তাঁদের তিন বোন, প্রত্যেকে চিন্তাচেতনায় উদার, আন্তরিক, নিরহংকার। শিবুদার ভাষা সবসময় শুদ্ধ, শান্তিপুরি। এমন ভাষায় সুন্দর করে কথা বলতে আমি আজ পর্যন্ত আর কাউকে শুনিনি। তিনি বক্তৃতা দিলে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো। তাঁর বক্তৃতার ধারা অনন্য। আগুনের ফুলকি ঝরতো তার কণ্ঠে। বহু গুণের এক সমন্বয় তার মধ্যে ঘটেছিলো। এতো কমে সন্তুষ্ট, এতো দুঃখ কষ্টের সঙ্গে দিন কাটিয়ে, নিজের চরিত্রের স্খলন না ঘটিয়ে শতভাগ সফল, এমন আর মাত্র কয়েকজন হাতেগুনা রাজনীতিবিদ দেখেছি। তখনকার ছাত্র রাজনীতি এমনই ছিলো। তিনি একটা ভাতের দোকান দিয়েছিলেন, আজিজ সুপারের দুতলায়, পেছনে। একদিন সেখানে খেতে যাই, ভাবি এবার স্বচ্ছল হবেন তিনি, নিজ হাতে সার্ভ করছেন, আমাকে পেয়ে কতো কথা বললেন, ভাতের দোকান নাম ‘অন্তরে’। কী আধুনিক চিন্তা। কুমিল্লা এলেন মাঝখানে, একটা পত্রিকা কিছুদিন চালিয়েছিলেন। আমাকে বললেন, নিয়মিত লিখতে হবে। একবার প্রয়াত হাবিব ভাই, আরেক বিপ্লবী, তার বাসায় এসেছিলেন আমাকে খোঁজে নিলেন, রাজনীতি ইত্যাদী নিয়ে কথা বললেন। দমবার পাত্র তিনি নন। 

ভিক্টোরিয়া কলেজে করতেন- ছাত্র শক্তি। কী যে তারুণ্য ভরা রাজনীতি ছিলো তখন! ছাত্র লীগ- ইপসো। ইলেকশন হলে দুই দলের স্লোগানে মুখর। দুই দল কখনো মিশে যেতো। কোনো ধাক্কাধাক্কিও হতো না। আমাদের পাড়ার শিবুদা। আমার অহংকার তাই বেশি। আসলে তিনি সারা দেশের অহংকার। তিনি আমাদের প্রথম জাতীয় পতাকার রূপকার। এ তঘমা তার (!), ইতিহাস সসম্মানে বিবেচনা করবে। তার জীবন নিয়ে অনেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখতে পারবেন, বিশেষত তার রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন নিয়ে; সে যোগ্যতা আমার নেই।  হয়তো অনেক লেখা হবে। হতেই হবে। শিবুদাকে নিয়ে লেখা মানে পাকিস্থানের বৈষম্য নিয়ে, দেশ ও কৃষ্টি নিয়ে, স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা। ইতিহাসের এসব সন্ধিতে তিনি হাড়ে- চর্মে জড়িত। তিনি আহমদ ছফার কবিতার বই সম্পাদনা করেছেন। আরও বহু কিছু। বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের ধারায় মেহেনতী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে তার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত, যা তিনি বিশ্বাস করতেন, হতে পারে তায় ভিন্ন মত রয়েছে, বিলিয়ে দিয়েছেন। কতো জনে কতো কী হলেন, শিবুদা কিছু হলেন না। 

শেষ পর্যন্ত অভিমানে ছোট হতে হতে ছোট হয়েও বড় মন নিয়ে একা লড়ে গেলেন, লড়া বলে না তাকে, বলেÑ ভেবে গেলেন। কারো সঙ্গে হয়তো মিললো না তার চিন্তা, অথবা মিলতে মিলতে মিললো না। তবুও নীতি থেকে টলেননি। পাকিস্তানের পতাকা পুড়ে পাক হানাদারের কাছে হয়েছিলেন চরম ঘৃণ্য। তাকে খুঁজতে গিয়ে বারবার পাক সেনা এসেছিলো আমাদের পাড়ায়, আমাদের বাসায়- কোথাও লুকিয়ে তিনি নেই তো। একবার হানাদার আমাকে সন্দেহ করে। তারপর পাকি এলেই আমি দিতাম ছুট পেছনের দেয়াল টপকে শহরের প্রধান পানির ট্যাংকির তলায়, সেখান থেকে চৌদিকে যাবার অনেক সুযোগ। শিবুদার সেই অভিমান আজ সারা দেশে বাতাসে কী ঘুরপাক খাচ্ছে। আর তাকে খোঁজে পাবে না পাকি, আর তাকে নিয়ে কেউ বলবে নাÑ লোকটা খেপাটে, লোকটা বড্ড সমালোচনা মুখর, তীর্যক কথা বলে, লোকটা একজন ইটিউপিক রূমান্টিকতাজাত চিন্তার ধারক। তার প্রয়াণে জাতি দুঃখ পেয়েছে। এমন ক্ষণে কিছু স্মৃতিচারণ করলাম। তার আত্মা শান্তিতে থাক। এ কামনা। 

[১] (সংশোধনী: প্রথমে লিখেছিলাম, পঁচিশে মার্চ রাতে শিবনারায়ন দাশের পিতাকে পাক আর্মি হত্যা করে, এটা হবে ২৬ মার্চ মধ্যরাতে তাঁর বাবাকে পাক আর্মি তোলে নিয়ে যায়, তিনি আর ফেরেননি) ও [২] পতাকার বিষয়ে শিবনারায়ণ দাশের এ সাক্ষাৎকারটি দেখা যেতে পারে। 

লেখক: চিকিৎসক